বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: জীবনী, সাহিত্য এবং অন্যান্য

Spread the love

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ১৮৩৮ সালের ২৬ জুন, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা এবং তাঁর মাতার নাম দুর্গাসুন্দরী দেবী। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। তাঁর পিতামহেরা হুগলি জেলার দেশমুখ গ্রাম থেকে এসেছিলেন।

শিক্ষা

বঙ্কিমচন্দ্র পাঁচ বছর বয়সে কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি দেন। তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রতিভা প্রকাশ করে লিখেছেন, “শুনিয়াছি বঙ্কিমচন্দ্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করিয়াছিলেন।” ১৮৪৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে আসেন, সেখানেই তার প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়।

মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনৈক এফ টিডের পরামর্শে পিতা যাদবচন্দ্র শিশু বঙ্কিমকে তার স্কুলে ভর্তি করান। ১৮৪৯ সালে, তিনি পুনরায় কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন এবং কাঁঠালপাড়ার শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। বঙ্কিমচন্দ্র খুব ভালো আবৃত্তিকার ও ছিলেন , তিনি সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত বহু কবিতা এই বয়সেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেছিলেন। তখন তিনি পণ্ডিত হলধর তর্কচূড়ামণির কাছে মহাভারত শ্রবণ করতেন। হলধরই তাকে শিক্ষা দেন – “শ্রীকৃষ্ণ আদর্শ পুরুষ ও আদর্শ চরিত্র”। এই শিক্ষা তার পরবর্তী জীবনে তাঁর রচিত বিভিন্ন রচনাতে প্রতিফলিত হয়েছিল। কিছুকাল পরে ১৮৪৯ সালে হুগলি কলেজে (অধুনা হুগলী মহসিন কলেজ) ভর্তি হন। এখানে পড়াকালীন, ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে বার্ষিক বৃত্তি লাভ করেন। হুগলি কলেজ অধ্যয়নকালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন।

তাঁর পিতার মতো তিনিও সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন, তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্‌টর পদে কর্মরত ছিলেন। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন, স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে – ১৮৯১ সালে, রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে, কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব।

কর্মজীবন

শিক্ষাজীবন শেষ করার পর, বঙ্কিমচন্দ্র সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। তিনি ১৮৫৮ সালে যশোর জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৮৬৩ সালে সরকারি পরিষেবাগুলি একত্রিত হওয়ার পর, তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং ১৮৯১ সালে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।

সাহিত্যকর্মের সূচনা এবং প্রথম লেখা

বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় কবিতা লিখে। তাঁর প্রথম সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয় ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের সাপ্তাহিক সংবাদপত্র সংবাদ প্রভাকর -এ। যদিও তাঁর প্রথম উপন্যাস, ইংরেজি ভাষায় লেখা রাজমোহনের স্ত্রী (১৮৬৪) বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়নি কিন্তু এটি ছিল তাঁর প্রথম সাহিত্যকর্ম। তবে, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বাংলা উপন্যাস “দুর্গেশনন্দিনী“‘ (১৮৬৫) ছিল বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস এবং এটি বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল।

প্রধান সাহিত্যকর্ম ও প্রভাব

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের এক নতুন ধারার প্রবর্তক ছিলেন। তাঁর লেখা উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ এবং সাহিত্যিকর্ম সমসাময়িক ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তার অন্যতম প্রধান লেখনীআনন্দমঠ (১৮৮২), যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের একটি অমূল্য গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত। এই উপন্যাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহীদের ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এবং এখান থেকেই “বন্দে মাতরম‘ গানটির উদয় ঘটেছে, যা পরবর্তী সময়ে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি উজ্জীবিত সঙ্গীত হয়ে ওঠে। এই গানটি ভারত মাতার পূজ্য সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়।

বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯), বিশবৃক্ষ (১৮৭৩), দেবী চৌধুরানী (১৮৮৪), রাজসিংহ (১৮৮১) এবং কামালাকান্ত (১৮৮৫) এবং অন্যান্য। তাঁর লেখনীতে পুরাতন ঐতিহ্য এবং নতুন যুগের ভাবনার সংমিশ্রণ ঘটেছে।

ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তা

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন দার্শনিক এবং তাঁর কাজের মধ্যে ধর্ম ও দর্শনের গভীর মেলবন্ধন ঘটেছে। তিনি শ্রীমদ্ভগবদগীতা-এর একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা রচনা করেন, যেটি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। এছাড়াও, তিনি সংখ্যা দর্শন সম্পর্কে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যেটি ভারতীয় দর্শন ও ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হিসেবে পরিচিত।

বঙ্কিমচন্দ্র এবং রামকৃষ্ণ পরমহংস

বঙ্কিমচন্দ্রের সাথে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর এবং নিকট। বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজি জানতেন, কিন্তু রামকৃষ্ণ জানতেন না, তবুও তাদের মধ্যে একটি চমৎকার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একবার রামকৃষ্ণ পরমহংস বঙ্কিমচন্দ্রের নামের অর্থ নিয়ে মজা করেছিলেন, এবং জানতে চেয়েছিলেন কী কারণে বঙ্কিমচন্দ্র হয়েছেন বঙ্কিম অর্থাৎ বাঁকা হয়েছেন, যার উত্তরে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় হাস্যরসাত্মকভাবে বলেছিলেন যে তিনি ইংরেজের জুতার আঘাতে “বাঁকা” হয়েছেন। কারণ তিনি সমসাময়িক ব্রিটিশ সরকারের তীব্র করেছেন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উত্তরাধিকার

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম আজও জীবন্ত এবং প্রাসঙ্গিক। তাঁর লেখা উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ এবং গানগুলো শুধু সাহিত্যের দিক থেকে নয়, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।

তাঁর লেখা বন্দে মাতরম গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তাঁর সাহিত্যিক দৃষ্টি ও লেখনীর জন্য, তিনি “সাহিত্য সম্রাট” হিসেবে খ্যাত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, “বঙ্কিমচন্দ্র দুই হাতে সমান শক্তি রাখতেন, এক হাতে সৃষ্টি করতেন সাহিত্য কর্ম, আর অন্য হাতে মুছতেন অজ্ঞতার কালো ছায়া।”

উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মসমূহ

বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যকর্ম অত্যন্ত জীবন্ত এবং বৈচিত্র্যময়। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য উপন্যাস এবং সাহিত্য হল:

১. দুর্গেশনন্দিনী
২. কপালকুণ্ডলা
৩. আনন্দমঠ
৪. রাজসিংহ
৫. দেবী চৌধুরানী

এছাড়াও, তাঁর ধর্মীয় এবং দার্শনিক প্রবন্ধ যেমন শ্রীমদ্ভগবদগীতা এবং সংখ্যা দর্শন, ভারতীয় চিন্তাধারা ও দর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে রয়ে গেছে।

মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালের ৮ এপ্রিল, মাত্র ৫৫ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এক বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তিনি আজও সজীব রয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদানের স্মৃতিস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রতিবছর “বঙ্কিম পুরস্কার” প্রদান করে ।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক অমর রচয়িতা, তাঁর অবদান বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং জাতীয়তাবাদে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *