মধুসূদন দত্ত: জীবন, সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

Spread the love

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য প্রতিভা। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং আধুনিক বাংলা সাহিত্যের স্রষ্টা। তাঁর সাহিত্যকর্ম শুধু বাংলায় সীমিত নয়, বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষাপটেও উল্লেখযোগ্য। মাইকেলের জীবন ছিল সংগ্রামমুখর, সৃজনশীল এবং রোমাঞ্চকর, এবং তা তাঁর লেখনীতে প্রতিফলিত হয়েছে।

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন

মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত, যিনি একজন শিক্ষিত ও সম্মানিত জমিদার ছিলেন এবং মা জাহ্নবী দেবী ছিলেন গৃহিণী। মধুসূদন ছিলেন এক উচ্চবিত্ত হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত।

প্রাথমিক শিক্ষার পর তাঁর পিতা তাঁকে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতার হিন্দু কলেজে পাঠান, সেখানে মধুসূদন পাশ্চাত্য শিক্ষার সাথে পরিচিত হন। হিন্দু কলেজে অধ্যয়নকালে তাঁর মধ্যে পাশ্চাত্য সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর আগ্রহের জন্ম হয়। ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসন নামক একজন ব্রিটিশ শিক্ষক মধুসূদনের মধ্যে লর্ড বায়রন এবং অন্যান্য রোমান্টিক কবিদের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করেন।

পশ্চিমী সংস্কৃতি ও ধর্মান্তর

হিন্দু কলেজে পড়াকালে, মধুসূদন দত্ত ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি একধরনের বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে শুরু করেন। তিনি ইউরোপীয় সভ্যতার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং নিজেকে ইউরোপীয় সংস্কৃতির একজন অংশীদার হিসেবে কল্পনা করতে থাকেন।

এই আকর্ষণ থেকেই তিনি ১৮৪৩ সালে, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। কলকাতার ওল্ড মিশন চার্চে তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন, এবং তাঁর নামকরণ হয় মাইকেল। তাঁর এই পদক্ষেপ পরিবারের সাথে তীব্র বিরোধ সৃষ্টি করে, এর ফলে তাঁকে হিন্দু কলেজ ছাড়তে হয়। এরপর, তিনি বিশপস কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন।

মাদ্রাজে জীবনযাপন

১৮৪৭ সালে মধুসূদন মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) চলে যান। সেখানে তিনি আর্থিক সংকট এবং পারিবারিক সমস্যার মুখোমুখি হন। মাদ্রাজে তিনি একজন শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং “মাদ্রাজ সার্কুলেটর” ও অন্যান্য পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন।

মাদ্রাজে থাকাকালীন তিনি রেবেকা থম্পসন ম্যাকটাভিশ নামে এক স্কটিশ তরুণীকে বিয়ে করেন, এটি ছিল তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। রেবেকার সাথে তাঁর চার সন্তান হয়, তবে মধুসূদন পরবর্তীতে রেবেকাকে ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন।

বাংলা সাহিত্যে অভ্যুদয়

১৮৫৮ সালে কলকাতায় ফিরে মধুসূদন বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করেন। তাঁর বন্ধু গৌর দাস বসাক এবং জনৈক বিটুনের অনুপ্রেরণায় তিনি মাতৃভাষায় লেখার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন।

বাংলা সাহিত্যে তাঁর অভিষেক ঘটে নাটকের মাধ্যমে। তাঁর প্রথম নাটক “শর্মিষ্ঠা” (১৮৫৯) বাংলা সাহিত্যের নাট্যধারায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এরপর তিনি “পদ্মাবতী”, “একেই কি বলে সভ্যতা”, এবং “কৃষ্ণকুমারী” প্রভৃতি রচনা করেন।

মধুসূদনের সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা “মেঘনাদবধ কাব্য”, যা 1861 সালে প্রকাশিত হয়। এটি রামায়ণের রাবণের পুত্র মেঘনাদের মৃত্যুর উপর ভিত্তি করে রচিত একটি মহাকাব্য।

তাঁর লেখা অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল:

  • তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য
  • ব্রজাঙ্গনা কাব্য
  • বীরাঙ্গনা কাব্য

মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেটের প্রচলন করেন। তাঁর বিখ্যাত সনেট “কপোতাক্ষ নদ” আজও পাঠকদেরকে মুগ্ধ করে।

ইউরোপে যাত্রা ও আইনজীবী হওয়া

১৮৬২ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে যান। তিনি গ্রেস ইন-এ ভর্তি হন এবং সেখানে আইনের পাঠ গ্রহণ করেন। পরে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আর্থিক সহায়তায়, ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে কিছুদিন বসবাস করেন।

১৮৬৭ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং উচ্চ আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তবে তাঁর আর্থিক অবস্থা কখনও স্থিতিশীল ছিল না।

ব্যক্তিগত জীবন ও সম্পর্ক

মধুসূদনের ব্যক্তিগত জীবন ছিল অগোছালো এবং সংগ্রামময়। রেবেকাকে ছেড়ে আসার পর তিনি এমিলি হেনরিয়েটা সোফি হোয়াইটের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। এমিলির সাথে তাঁর তিনটি সন্তান হয়। তাঁর সম্পর্কের জটিলতা এবং আর্থিক সংকট তাঁর জীবনে নানা সমস্যা সৃষ্টি করে।

শেষ জীবন ও মৃত্যু

মধুসূদনের শেষ জীবন ছিল দারিদ্র্য, অসুস্থতা এবং দুঃখে ভরা। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর মাত্র তিন দিন আগে তাঁর স্ত্রী এমিলিও গিয়েছিলেন।

উত্তরাধিকার

মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যকর্ম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। তাঁর কবিতা, নাটক এবং গদ্য বাংলা ভাষায় আধুনিকতার সূচনা করে।

তাঁর স্মৃতিতে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মঞ্চের নামকরণ করা হয়েছে। যেমন:

  • মাইকেল মধুসূদন কলেজ (বাংলাদেশ)
  • মধুসূদন মঞ্চ (পশ্চিমবঙ্গ)

উপসংহার

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের এক অমর প্রতিভা। তাঁর জীবন ছিল সংগ্রামমুখর, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকর্ম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অমূল্য রত্ন। তাঁর লেখা বাংলা সাহিত্য পাঠকের মনে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *