আশাপূর্ণা দেবী: বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

Spread the love

আশাপূর্ণা দেবী (৮ জানুয়ারি ১৯০৯ – ১২ জুলাই ১৯৯৫), যিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে নারীর জাগরণ এবং সমাজের গভীর পরিবর্তনের কাহিনী তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখনীতে নারী জীবনের অন্তর্নিহিত সংগ্রাম, সামাজিক বাধা এবং অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে প্রতিফলন ঘটেছে।

শৈশব এবং পরিবার

আশাপূর্ণা দেবীর, উত্তর কলকাতা পটলডাঙ্গার এক ঐতিহ্যবাহী বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি এক কঠোর রক্ষণশীল পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। তখন সেখানে মেয়েদের জন্য লেখাপড়ার তেমন সুযোগ ছিল না। আশাপূর্ণা দেবী জ্ঞান অন্বেষণের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন তাঁর মা সরলা সুন্দরী দেবীর কাছে থেকে, কারণ তিনি বই পড়তে খুবই ভালোবাসতেন। বাড়ির পুরুষদের কে তিনি পড়াশোনা করতে দেখতেন, এবং তাদের পড়া শুনে শুনে তিনি বর্ণমালা শেখেন। এইভাবে স্বশিক্ষার মাধ্যমেই তাঁর সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জমে এবং সাহিত্যিক প্রতিভার বিকাশ ঘটে।

সাহিত্যিক জীবনের সূচনা

আশাপূর্ণা দেবীর লেখা “বাইরের ডাক” কবিতাটি প্রথম এক শিশু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। এই ছোট্ট কবিতা দিয়েই তাঁর সাহিত্য জীবনের সূচনা ঘটে।

পরবর্তী সময়ে, তিনি শিশু এবং কিশোরদের জন্য অসংখ্য সৃষ্টি উপহার দেন। ১৯৩৬ সালে, প্রথম প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা তাঁর গল্প “পত্নী ও প্রেয়সী” তাঁকে নতুন পরিচিতি এনে দেয়। এরপর থেকে তিনি ক্রমশ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাহিত্য রচনা করে গেছেন।

প্রধান সাহিত্যকর্ম এবং সাহিত্য দর্শন

আশাপূর্ণা দেবীর রচনাসমূহ মূলত নারী জীবন, তাঁদের স্বপ্ন এবং সংগ্রামকে কেন্দ্র করেই লেখা। তাঁর প্রথম উপন্যাস “প্রেম ও প্রয়োজন” (১৯৪৪) থেকে শুরু করে বিখ্যাত ত্রয়ী উপন্যাস “প্রথম প্রতিশ্রুতি” (১৯৬৪), “সুবর্ণলতা” (১৯৬৭), এবং “বকুল কথা” (১৯৭৪) পর্যন্ত প্রতিটি সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি।

  1. প্রথম প্রতিশ্রুতি: এই উপন্যাসে তিনি ১৯ শতকের নারী জীবনের বাস্তব ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। নারীশিক্ষার প্রতি সমাজের অনীহা, কুসংস্কার এবং নারীর ওপর সামাজিক নিয়মের শৃঙ্খল প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে।
  2. সুবর্ণলতা: এটি হল প্রথম প্রতিশ্রুতির সিক্যুয়েল। এখানে দেখা গেছে যে, এক শিক্ষিত নারী সমাজের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করছেন এবং তাঁর নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন।
  3. বকুল কথা: এটি ত্রয়ী উপন্যাসের শেষ অংশ, এখানে নারীর ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতা, এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার মেলবন্ধন উল্লেখ করেছেন।

ভাষাশৈলী এবং সাহিত্য প্রভাব

আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্য সৃষ্টি সহজ এবং প্রাণবন্ত ভাষায় রচিত। তাঁর লেখনীতে বাংলা সমাজের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠতে দেখা যায়। তিনি জটিল এবং গভীর বিষয়গুলোকে সরল অথচ গভীরভাবে উপস্থাপনা করেছেন।

  1. নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার: তাঁর লেখায় প্রায়ই নারীর স্বাধীনতা এবং সমতা পাওয়ার সংগ্রামের চিত্র ফুটে উঠেছে।
  2. সামাজিক ব্যঙ্গ: তিনি সমাজের অন্যায় এবং কুসংস্কারের প্রতি তীব্র নিন্দা এবং প্রকাশ করেছেন।
  3. নারীর মানসিকতা: তাঁর রচনাতে নারীর অনুভূতি এবং মানসিকতা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।

পুরস্কার ও সম্মান

আশাপূর্ণা দেবী, জীবদ্দশায় অনেক মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। যেমন;

  1. জ্ঞানপীঠ পুরস্কার (১৯৭৬)
  2. পদ্মশ্রী (১৯৭৬)
  3. সাহিত্য একাডেমি ফেলোশিপ (১৯৯৪)

    উপসংহার

    আশাপূর্ণা দেবী বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন। তাঁর সাহিত্যকর্ম নারীর জীবন, সামাজিক অসাম্য এবং মানুষের নৈতিক চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। তাঁর লেখা শুধু সাহিত্যিক দিক থেকে নয়, মানবিকতার দিক থেকেও বিশেষভাবে বিবেচিত। তাঁর সৃষ্টি বাংলা সাহিত্য এবং সমাজে চিরকাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

    Similar Posts

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *