রাজশেখর বসু (পরশুরাম) : জীবনী, সাহিত্য এবং অন্যান্য

Spread the love

রাজশেখর বসু (পরশুরাম), বাংলা সাহিত্যের এক অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর লেখনীতে হাস্যরস, সমাজের সমালোচনা, এবং মানুষের মনোবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ প্রভৃতির অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটেছে।

পরশুরাম নামেই তিনি বেশি পরিচিত, এবং এই নামে লিখিত তাঁর রচনা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

  1. সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়: শৈশব এবং শিক্ষাজীবন, সাহিত্যিক জীবন ও প্রধান রচনাসমূহ
  2. হুমায়ূন আহমেদ: জীবনবৃত্তান্ত, সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য
  3. বুদ্ধদেব বসু: জীবন, সাহিত্য এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি

রাজশেখর বসুর শৈশব ও প্রাথমিক জীবন

রাজশেখর বসু ১৮৮০ সালের ১৬ মার্চ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার কাঁদোর্শোনা গ্রামে এক সুপরিচিত বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পিতা বৈদ্যনাথ বসু ছিলেন একজন বিশিষ্ট আয়ুর্বেদ চিকিৎসক এবং মা ছিলেন গৃহিণী। শৈশব থেকেই রাজশেখর অত্যন্ত মেধাবী ও জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতায় যান।

শিক্ষাজীবন

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি রসায়নবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবনে তিনি সবসময়ই মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন। তার রসায়নবিদ্যায় উচ্চশিক্ষা লাভের প্রেরণা ছিল বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অনুপ্রেরণা। রাজশেখরের বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি সাহিত্যের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল।

রাজশেখর বসুর পেশাজীবন

রাজশেখর বসু তাঁর শিক্ষাজীবন শেষ করার পর কলকাতার বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডে যোগদান করেন। বেঙ্গল কেমিক্যালসের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। রাজশেখর বসু এখানে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে সংস্থার পরিচালক পদে আসীন হন। তাঁর নেতৃত্বে বেঙ্গল কেমিক্যালস অনেক উন্নতি লাভ করে এবং ভারতের অন্যতম প্রধান ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থায় পরিণত হয়। এই সময়ে তিনি বহু নতুন ওষুধ আবিষ্কার এবং গবেষণা করেন, যা ভারতীয় ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

সাহিত্যজীবনের শুরু

রাজশেখর বসুর সাহিত্যে আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই ছিল। তিনি ১৯২২ সালে পরশুরাম ছদ্মনামে “গড্ডালিকা” নামে একটি ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশ করেন। এই গল্পসংকলনটি তখনকার সাহিত্যজগতে যথেষ্ট প্রশংসিত হয়।

তার রচিত গল্পগুলি মূলত হাস্যরস ও ব্যঙ্গের মিশ্রণে রচিত। রাজশেখর বসু তাঁর লেখনীর মাধ্যমে বাংলার সমাজের নানা অসঙ্গতি ও কুসংস্কারকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর রচনা পাঠকদের মনোরঞ্জন করার পাশাপাশি তাদের চিন্তায় মগ্ন করেছে।

রাজশেখর বসু: সাহিত্যে অবদান

“গড্ডালিকা” ছাড়াও তাঁর আরো কিছু উল্লেখযোগ্য রচনা হল “ভূতগন্ধা“, “হিঙ্গ টিং ছট“, “হাসি ও চোখের জল” ইত্যাদি। তাঁর গল্পে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা, কুসংস্কার ও অবিচারের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ ব্যক্ত করেছেন।

রসায়নবিদ্যা ও রাজশেখর বসু

রাজশেখর বসু একজন সফল রসায়নবিদ ছিলেন। তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালসে কাজ করার সময় বহু নতুন ওষুধ আবিষ্কার করেন এবং গবেষণার মাধ্যমে সংস্থাকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেন। তাঁর কর্মজীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল নতুন নতুন ওষুধের গবেষণা ও উৎপাদন। এই কারণে তিনি শুধু বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে নয়, ভারতের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পেও স্মরণীয় স্থান অধিকার করেছেন।

অনুবাদসাহিত্য

রাজশেখর বসু সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনূদিত “মহাভারত” একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সমাদৃত গ্রন্থ। তিনি মহাভারতকে মূল সংস্কৃত ভাষার রস ও ভাব বজায় রেখে বাংলায় সহজবোধ্য ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এছাড়া তাঁর অনূদিত অন্যান্য গ্রন্থগুলির মধ্যে “গৌতমের বুদ্ধ চরিত” অন্যতম।

অভিধান প্রণেতা হিসেবে রাজশেখর বসু

রাজশেখর বসু একজন দক্ষ অভিধানপ্রণেতা ছিলেন। তিনি “পরাশর” ছদ্মনামে একাধিক অভিধান রচনা করেছেন, যার মধ্যে “চলন্তিকা” ও “পরিবর্তন” সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। “চলন্তিকা” বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিধান হিসেবে স্বীকৃত।

সাহিত্যক্ষেত্রে পুরস্কার ও সম্মাননা

রাজশেখর বসু তাঁর সাহিত্যিক কৃতিত্বের জন্য অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৫৬ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করা হয়। ১৯৫৮ সালে তাঁর রচিত “আনন্দীবাই ইত্যাদি গল্প” সংকলনের জন্য তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া তাঁর অন্যান্য রচনা ও অনুবাদের জন্যও তিনি বহুবার সম্মানিত হন।

রাজশেখর বসুর ব্যক্তিগত জীবন

রাজশেখর বসু ব্যক্তিগত জীবনে একজন সজ্জন ও সমাজসেবক ছিলেন। তিনি সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সচেতন ছিলেন এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি মানুষের সেবা ও কল্যাণকে প্রধান্য দিয়েছেন।

মৃত্যু

১৯৬০ সালের ২৭ এপ্রিল রাজশেখর বসু মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য ও রসায়নবিদ্যার জগতে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তবে তাঁর লেখনী ও কৃতিত্ব আজও বাংলার জনমানসে বেঁচে রয়েছে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *