কন্যাশ্রী প্রকল্প (Kanyashree Prakalpa in West Bengali): সর্ম্পূণ বিবরণ

Kanyashree Prakalpa- কন্যাশ্রী প্রকল্প
Spread the love

পশ্চিমবঙ্গে কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা হল প্রায় ১.৭৩ কোটি, যার মধ্যে ৪৮.১১% মেয়ে। এই কিশোরী বয়স (১০-১৯ বছর) জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময়েই মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ এবং মানবপাচারের মতো সামাজিক সমস্যাগুলি দেখা দেয়।

এই সমস্যাগুলি মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক বিকাশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই সমস্যার সমাধান করতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কন্যাশ্রী নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে।

কন্যাশ্রী প্রকল্প: কেন ?

  • ভারতের বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ আইন, ২০০৬ অনুযায়ী, মেয়েদের জন্য বিবাহের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর। কিন্তু DLHS-3 (২০০৭-০৮) অনুযায়ী, রাজ্যে প্রতি দুটি মধ্যে একজন বাল্যবিবাহের শিকার অর্থাৎ ৫৪.৭%
  • কলকাতার বস্তি এলাকাতেও এক-চতুর্থাংশ মেয়ের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়।
  • এভাবে তার নাবালিকা বয়সেই যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
  • এর ফলে তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক প্রভাব পড়ে ও স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
  • NFHS III, ২০০৫-০৬ অনুযায়ী, ৬-১০ বছর বয়সী মেয়েদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি 85 শতাংশ থাকলেও, 15-7 বছর বয়সে তা 33 শতাংশ-তে নেমে আসে।
  • আর্থিক সচছলতা না থাকায় অধিকাংশ নারী দারিদ্র্যতা এবং শোষণের শিকার হন।
  • দারিদ্র্য বাল্যবিবাহের কারণ এবং এটি মেয়েদের দারিদ্র্যের চক্রে আবদ্ধ করে।
  • PCMA ২০০৬ চালু হওয়ার পর, নারী উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ বিভাগ বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতা প্রচার করে।
  • বাল্যবিবাহ করলে শাস্তির বিধান দেওয়া হয়। পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাল্যবিবাহকে এখনও ন্যায্য বলে মনে করা হয়।

এইসব সমস্যাগুলিকে দূর করতে এবং মেয়েদের ক্ষমতায়িত করতে কন্যাশ্রী প্রকল্পটির সূচনা করা হয়।

কন্যাশ্রী প্রকল্পের উদ্দেশ্য

  • কন্যাশ্রী প্রকল্প আর্থ-সামাজিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের মেয়েদের জীবনমান ও মর্যাদা উন্নত করতে কাজ করে।
  • মেয়েদের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বা সমতুল্য প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে উৎসাহিত করে।
  • দীর্ঘমেয়াদে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান মজবুত করার লক্ষ্য রয়েছে।
  • ১৮ বছরের আগে বিয়ে না করার প্রবণতা তৈরি করে।
  • কম বয়সে বিয়ের ফলে মাতৃত্ব ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি, অপুষ্টি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
  • মেয়েদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক।
  • প্রকল্পটি আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মেয়েদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে।
  • অর্থ সরাসরি মেয়েদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রদান করা হয়, যাতে তারা নিজেরাই অর্থ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
  • মেয়েদের আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করতে কাজ করে।
  • সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ইভেন্ট, প্রতিযোগিতা ও কন্যাশ্রী ক্লাবের আয়োজন।
  • শক্তিশালী নারীদের রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরে তাদের অনুপ্রাণিত করা।
  • স্কুলে থাকা মেয়েরা দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করে ভবিষ্যতে আর্থিকভাবে স্বাধীন হবে।
  • ১৮ বছর বয়সের পর বিয়ে হলেও শিক্ষা ও মানসিক বিকাশ তাদের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের ভিত মজবুত করবে।
  • দীর্ঘমেয়াদে, শিশুবিবাহ বন্ধ হবে এবং নারীরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক সমতা অর্জন করবে।

কন্যাশ্রী প্রকল্প ও নগদ সাহায্য

কন্যাশ্রী প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হল: মেয়েরা যেন স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে এবং অন্তত ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত যেন তাদের বিয়ে না হয়। এই প্রকল্পে দুটি ধরণের আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়:

বার্ষিক স্কলারশিপ: ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েরা যারা অষ্টম শ্রেণি বা তার উপরের শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে, তারা প্রতি বছর ₹৭৫০/- টাকা করে পায়।

এককালীন অনুদান: যখন কোনো মেয়ে ১৮ বছরে পা দেয়, তখন তাকে এককালীন ₹২৫,০০০/- টাকা দেওয়া হয়।

কন্যাশ্রী প্রকল্পের শর্তাবলী

  • শিক্ষার্থী মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক কিংবা বৃত্তিমূলক, কারিগরি বা ক্রীড়া প্রশিক্ষণের ছাত্রী হতে হবে।
  • এই প্রকল্প বিশেষত দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের জন্য, তাই পরিবারের বার্ষিক আয় ₹১,২০,০০০/- টাকার কম হতে হবে।
  • তবে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মেয়েরা (Physically Handicapped), অনাথ, এবং জুভেনাইল হোমে থাকা মেয়েদের ক্ষেত্রে আয়ের এই সীমা প্রযোজ্য নয়।
  • বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মেয়েরা যদি অষ্টম শ্রেণির নিচের কোনো ক্লাসে পড়ে, তারাও বার্ষিক স্কলারশিপের জন্য যোগ্য।

কন্যাশ্রী প্রকল্পের উদ্দেশ্য শুধু অর্থ সাহায্য দেওয়া নয়, মেয়েদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পূরণ করতে পাশে দাঁড়ানো। এটি তাদের স্বাধীন ও আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে সাহায্য করে।

কন্যাশ্রী প্রকল্প: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

কন্যাশ্রী প্রকল্পর নকশা এবং সুশাসনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসিত বহুবার প্রসংশিত হয়েছে।

প্রাপ্ত পুরস্কারসমূহ:

  • মুখ্যমন্ত্রীর নারী ক্ষমতায়ন পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ (২০১৪)
  • মন্থন অ্যাওয়ার্ড (দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক), ২০১৪ – ই-উইমেন ও এমপাওয়ারমেন্ট বিভাগে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির জন্য।
  • জাতীয় ই-গভর্নেন্স পুরস্কার, ২০১৪-১৫
  • স্কচ অ্যাওয়ার্ড ও অর্ডার অফ মেরিট, ২০১৫ – স্মার্ট গভর্নেন্সের জন্য।
  • সিএসআই-নিহিলেন্ট পুরস্কার, ২০১৪-১৫।
  • জাতিসংঘের WSIS প্রাইজ ২০১৬

কন্যাশ্রী প্রকল্প: সামিট এবং আয়োজন থেকে পুরস্কার লাভ

  • “গার্লস’ সামিট” (লন্ডন, জুলাই ২০১৪) – DFID এবং UNICEF এর আয়োজনে।
  • “বাল্যবিবাহ ও কিশোরী মাতৃত্ব” বিষয়ক পরামর্শ সভা (দিল্লি, মার্চ ২০১৫) – টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেসের আয়োজনে।
  • “কিশোরীদের ক্ষমতায়ন” বিষয়ে আলোচনা (রাঁচি, মে ২০১৫) – বিশ্বব্যাংকের আয়োজনে।
  • “শিশুদের জন্য শর্তাধীন নগদ প্রণোদনা” বিষয়ক জাতীয় কর্মশালা (দিল্লি, ডিসেম্বর ২০১৫) – নীতি আয়োগের আয়োজনে।
  • Trafficking in Persons (TIP) এনক্লেভ (শিলিগুড়ি, ফেব্রুয়ারি ২০১৬) – মার্কিন কনস্যুলেট ও শক্তি বাহিনীর আয়োজনে।

কন্যাশ্রী প্রকল্প কেবলমাত্র এক উদ্যোগ নয়, এটি মেয়েদের স্বপ্নপূরণের এক হাতিয়ার। সমাজে কন্যাশ্রীর সাফল্যের গল্প এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে।

source:

  1. https://wb.gov.in/government-schemes-details-kanyashree.aspx
  2. https://wbkanyashree.gov.in/kp_4.0/index.php
  3. https://wbkanyashree.gov.in/readwrite/publications/000086.pdf

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *