অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর: জীবন, সাহিত্য ও অন্যান্য

Spread the love

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১–১৯৫১) ছিলেন এক প্রতিভাবান শিল্পকর্মী। তাঁর সৃষ্টিতে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটেছে।

তিনি ছিলেন “ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট”-এর প্রতিষ্ঠাতা। শিল্পী, লেখক ও চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট-এ তাঁর অবদান রেখে গেছেন।

স্বদেশি শিল্প আন্দোলন এবং জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে তিনি এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন।

ঐতিহ্য ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৮৭১ সালের, ৭ই আগস্ট, কলকাতার জোড়াসাঁকোতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র।

তাঁর দাদু শ্রী গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র। সংস্কৃতি সমৃদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ এবং বেড়ে ওঠার সুবাদে, ছোটো থেকেই তাঁর মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতি ও শিল্পকলার প্রতি গভীর আগ্রহ জন্মায়।

১৮৮০-এর দশকে, অবনীন্দ্রনাথ কলকাতার সংস্কৃত কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৮৯০ সালে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে অধ্যয়ন করেন, তখনই তিনি ইউরোপীয় শিল্পীদের কাছ থেকে প্যাস্টেল ও তেলরঙের শিক্ষা অর্জন করেন। মুঘল ও রাজপুত শিল্প তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে।

বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টের পথিকৃৎ

তিনি ছিলেন বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টের প্রবর্তক। অজন্তা গুহা এবং মুঘল মিনিয়েচার শিল্পের প্রতি তিনি মুগ্ধ ছিলেন।

তাঁর আইকনিক চিত্রকর্ম ভারত মাতা জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। স্বদেশি আন্দোলনের সময় ভারতমাতা চিত্রটি, আন্দোলনের প্রতীক বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছিল।

শিল্পে নতুনত্বের সন্ধান

অবনীন্দ্রনাথ শুধু পুনরুজ্জীবন এর পাশাপাশি নতুনত্বকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। চীনা ও জাপানি ক্যালিগ্রাফির প্রভাব তাঁর কাজের মধ্যে দেখা যায় যার মাধ্যমে তিনি পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পচেতনার মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন।

আরব্য রজনী সিরিজ-এ (১৯৩০) এমন উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে তিনি আরব্য রজনীর গল্পগুলিতে উপনিবেশিক কলকাতার কসমোপলিটান ভাবমূর্তির সমালোচনা করেছেন।

সাহিত্যে অনন্য অবদান

অবনীন্দ্রনাথ, শিল্পী হিসেবে বিখ্যাত হলেও, একজন অসাধারণ লেখকও ছিলেন। শিশুদের জন্য লিখেছেন খিরের পুতুল, রাজকাহিনী, নালক, এবং বুড়ো আঙ্গলা

তিনি রাজকাহিনী গ্রন্থে ভারতীয় ইতিহাসের বীরত্ব ও তাদের আত্মত্যাগের কাহিনী তুলে ধরেছেন, অপরদিকে, বুড়ো আঙ্গলা ছিল একটি কল্পনার রাজ্য।

ব্যক্তিজীবন ও প্রভাব

১৮৮৮ সালে, অবনীন্দ্রনাথ সুহাসিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর বড় ভাই গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর-ও একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন এবং তাঁর বোন সুনয়নী দেবী যিনি পৌরাণিক ও গৃহস্থালির দৃশ্য চিত্রায়ণ করে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন।

অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাপানি শিল্পী ইয়োকোয়ামা তাইকান এবং শিল্পতাত্ত্বিক ওকাকুরা কাকুজোর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। স্যার উইলিয়াম রথেনস্টাইনের সঙ্গে ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। এরফলে ঠাকুর পরিবারের কাজ আন্তর্জাতিক মহলে ছড়িয়ে পড়ে। রথেনস্টাইনের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যাওয়া এবং গীতাঞ্জলি-র ইংরেজি প্রকাশনা, এই সবই সুসম্পর্কের ফসল।

আধ্যাত্মিকতা

অবনীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে পাশ্চাত্য শিল্প “ভৌতবাদী,” যা ভারতীয় শিল্পের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের থেকে ভিন্ন। তাঁর এই চিন্তাধারা ইউরোপের প্রি-রাফায়েলাইট এবং থিওসফি আন্দোলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক

অবনীন্দ্রনাথের ব্যাক্তিত্ব তাঁর ছাত্রদেরকে উদ্বুদ্ধ করে, নন্দলাল বসু, ক্ষীতীন্দ্রনাথ মজুমদার এবং মুকুল দের মতো শিল্পীরা তাঁর তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন এবং আধুনিক ভারতীয় শিল্পের বিকাশ ঘটান।

উত্তরাধিকার

১৯৫১ সালে তাঁর মৃত্যু পরও অবনীন্দ্রনাথের সৃষ্টি দীর্ঘদিন জনসমক্ষে আসেনি। পরে, তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র আলোকেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারে সংরক্ষিত প্রায় সমস্ত চিত্রকর্ম রবীন্দ্রভারতী সোসাইটিকে দান করেন।

সম্প্রতি, আর. শিবা কুমার এবং দেবাশীষ ব্যানার্জি তাঁর কাজের উপর গবেষণা করেছেন এবং শিবা কুমারের Paintings of Abanindranath Tagore (২০০৮) এবং ব্যানার্জির The Alternate Nation of Abanindranath Tagore (২০১০) অবনীন্দ্র নাথের সৃষ্টি ও দর্শনকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছে।

উপসংহার

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন এক শিল্পী যিনি অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছিলেন।অবনীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা এমন এক সাংস্কৃতিক মহীরুহকে স্মরণ করি, যিনি স্থান কাল ছাড়িয়ে আমাদের চিন্তা শক্তিকে প্রভাবিত করে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *