বুদ্ধদেব বসু: জীবন, সাহিত্য এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি
বুদ্ধদেব বসু (২ সেপ্টেম্বর ১৯০৮ – ১৪ আগস্ট ১৯৭৪) ছিলেন বিংশ শতকের প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি মূলত কবি হিসেবে পরিচিত হলেও, তার সাহিত্যিক প্রতিভা একাধিক শাখায় বিস্তৃত ছিল।
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার প্রবর্তক কবিদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাঙালি সাহিত্যজগতে এত বহুমুখী প্রতিভা আর কখনো আসেনি।
শিক্ষা জীবন
বুদ্ধদেব বসু বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং সেখানে জগন্নাথ হলে থাকতেন। ছাত্রজীবনে তিনি তার সহপাঠী নূরুল মোমেনের সাথে প্রথম বিনেট আইকিউ পরীক্ষা তে সর্বোচ্চ নম্বর লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা উতীর্ণ করার পর, তিনি ১৯৩১ সালে কলকাতায় চলে আসেন । এখানে তিনি কোনো নির্দিষ্ট চাকরি পাননি, তবে কোচিংয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন, বুদ্ধদেব বসু কল্লোল পত্রিকায় যুক্ত হন, যা ১৯৩০ দশকের আধুনিকতাবাদী সাহিত্য আন্দোলন “কল্লোল যুগ“-এর বিস্তার ঘটিয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি প্রগতি পত্রিকার সম্পাদক হন।
পারিবারিক জীবন
বুদ্ধদেব বসু ১৯৩৪ সালে প্রতিভা বসু (পূর্বে শোম) কে বিবাহ করেন। তাদের তিনটি সন্তান হয়: মিনাক্ষী দত্ত (১৯৩৬), দমায়ন্তী বসু সিং (১৯৪০) এবং সিদ্ধার্থ বসু (১৯৪৫–১৯৮৭)। প্রতিভা বসু নিজেও একজন দক্ষ গায়িকা ছিলেন, কিন্তু পরে সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং তিনিও একজন প্রখ্যাত লেখক হয়ে ওঠেন।
বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য জীবনের উত্থান
বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য জীবন শুরু হয় মাত্র ১৭ বছর বয়সেই। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ছিল “বন্দীর বন্দনা”। ১৮ বছর বয়সে তাঁর প্রথম উপন্যাস “সাড়া” প্রকাশিত হয়। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাহিত্য চর্চা করে গেছেন।
তাঁর লেখা মোট ৪০টি উপন্যাস, ১৬০টিরও বেশি গ্রন্থ, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রয়েছে, যেগুলি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম অমূল্য রত্ন হয়ে আছে। তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস “তিথিডোর” ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয় এবং এটি বাংলা সাহিত্যের একটি ক্লাসিক উপন্যাস হিসেবে পরিচি।
সাহিত্যে অবদান এবং লেখার ধারা
বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যিক শৈলী আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। তার কবিতায় পশ্চিমা সাহিত্য বিশেষত বদলেয়ার, ইজরা পাউন্ড, টি এস এলিয়ট, এবং রিলকে এদের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে প্রভাবিত হলেও, পরে তিনি আধুনিক ভাবধারায় প্রবাহিত হন। তিনি “শিল্পীর জন্য শিল্প” এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।
তিনি “কবিতা” পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি নতুন নতুন কবি ও সাহিত্যিকদের তুলে ধরেছিলেন, যাদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ হলেন অন্যতম।
অশ্লীলতার অভিযোগ এবং তার বিচার
বুদ্ধদেব বসুর লেখক জীবন একটি বিতর্কিত মুহূর্তের সম্মুখীন হয়েছিল। তার উপন্যাস “রাত ভরে বৃষ্টি” একটি ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী, যেখানে যৌনতা একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
এর ফলে উপন্যাসটি অশ্লীলতার অভিযোগে সরকার নিষিদ্ধ করে। তবে, উচ্চ আদালত এই অভিযোগ থেকে তাকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে। পরবর্তীতে এই উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ “Rain Through the Night” নামে প্রকাশিত হয়, যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়।
বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য সংগঠন ও পত্রিকা
বুদ্ধদেব বসু তাঁর ছাত্র জীবন থেকেই বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রগতি পত্রিকার সম্পাদনা করেন, যেটি ১৯২৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকার মাধ্যমে তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতির আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি কবিতা -ও লিখেছিলেন।
রচনা ও সাহিত্যে অবদান
বুদ্ধদেব বসু মোট প্রায় ২০০টি রচনা লিখেছেন, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি। তার কিছু উল্লেখযোগ্য প্রকাশন হল:
কবিতা:
- মরমোরণী (১৯২৪)
- বন্দীর বন্দনা (১৯৩০)
- কঙ্কাবতি (১৯৩৭)
- শ্রীষ্ট কবিতা (১৯৫৩)
- মরচে পরা পেরেকের গান (১৯৬৬)
উপন্যাস:
- সাড়া (১৯৩০)
- তিথিডোর (১৯৪৯)
- রাত্রি ভরে বৃষ্টি (১৯৬৭)
- গোলাপ কেনো কালো (১৯৬৭)
ছোটগল্প সংকলন:
- অভিনয়
- প্রেমের বিচিত্র গোতী
- খাতার শেষে পাতা
- ফেরিওয়ালা ও অন্যান্য গল্প
নাটক:
- তপস্বী ও তরঙ্গিনী
- কলকাতার ইলেক্ট্রা
- প্রথম পার্থ
পদ্মভূষণ এবং অন্যান্য স্বীকৃতি
বুদ্ধদেব বসুকে তার সাহিত্যকর্মের জন্য অনেক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। ১৯৬৭ সালে তিনি নাটক “তপস্বী ও তরঙ্গিনী” এর জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৭৪ সালে তিনি তার কাব্যগ্রন্থ “স্বাগত বিদায়” এর জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পান”। এছাড়া, ১৯৭০ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাকে পদ্মভূষণ পুরস্কার দেওয়া হয়।
উপসংহার
বুদ্ধদেব বসু শুধুমাত্র একজন কবি ছিলেন না, তিনি বাংলা সাহিত্যের দিকনির্দেশকও ছিলেন। তাঁর “কবিতা” পত্রিকা, “তিথিডোর” উপন্যাস এবং অন্যান্য সাহিত্যকর্মগুলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যিক অবদান ও লেখার কৌশল আমাদের আজও অনুপ্রাণিত করে।