কাজী নজরুল ইসলাম: জীবনী, সাহিত্য ও অন্যান্য
কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ) বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ) পশ্চিম বর্ধমান জেলার, আসানসোল সদর, চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও খাদেম, এবং মা ছিলেন জাহেদা খাতুন।
ছোটবেলায় “দুখু মিয়া” নামে পরিচিত নজরুল খুবই সাধারণ পরিবারে বড় হন। মাত্র ৯ বছর বয়সে বাবার অকালমৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব মেটাতে বিভিন্ন কাজ করতে বাধ্য হন যেমন মসজিদের মুয়াজ্জিন, মক্তব শিক্ষকতা, এমনকি চায়ের দোকানেও কাজ করেছেন।
প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
নজরুল স্থানীয় মক্তবে ইসলামী ধর্ম, ফার্সি ভাষা ও দর্শন অধ্যয়ন করেন। জীবিকা অর্জনের পাশাপাশি তিনি স্থানীয় লেটো দলে যোগ দেন। সেখানে তাঁর সাহিত্যিক ও সঙ্গীত প্রতিভা বিকশিত হয়। ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ত্যাগ করে পুনরায় পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন। তবে আর্থিক সমস্যার কারণে নিয়মিত পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেননি।
সৈনিক জীবন
১৯১৭ সালে নজরুল ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং করাচিতে তার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেখান থেকেই তিনি কবিতা ও গল্প লেখা শুরু করেন। তিনি তাঁর প্রথম কবিতা “মুক্তি” এবং প্রথম গদ্য “বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী” সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন রচনা করেছিলেন। সৈনিক হিসেবে তার দায়িত্ব পালনকালে তাঁকে ফার্সি ভাষা শিখতে হয় তার সাথে সাথে সাহিত্যচর্চায় যুক্ত ছিলেন।
পারিবারিক জীবন
কাজী নজরুল ইসলামের ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন ঘটনা তার সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটে। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে, তাঁর প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচয় ঘটে। এবং সেই সূত্রেই কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে এসে প্রমীলা দেবীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। প্রথমে তাদের মধ্যে প্রণয় গড়ে ওঠে, পরে তা বিবাহে রূপ নেয়।
তবে এর আগে নজরুল আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমকে বিবাহ করেছিলে। কাবিনের শর্ত অনুযায়ী নজরুল ঘরজামাই থাকতে অস্বীকৃতি জন তাই বাসর রাতের আগেই তিনি কুমিল্লা চলে আসেন। সেখানে তিনি অসুস্থ হলে প্রমীলা দেবী তার সেবা করতেন, এইভাবে তাদের মধ্যে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।
নজরুল ছিলেন সাম্যবাদের এক অগ্রণী পুরোধা। তিনি তাঁর চার সন্তানের নামকরণ বাংলা করেন যা আরবি-ফারসি ভাষার সংমিশ্রণে গঠিত। এই ধারণা তার মানবিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় প্রকাশ করে। তার সন্তানদের নামগুলি হল: কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।
সাহিত্য জীবনের সূচনা
তিনি ১৯২০ সালে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন এবং সেখানে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু করেন। তাঁর লেখা “বাঁধনহারা”, “শাত-ইল-আরব”, এবং “কোরবানি” কবিতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন সাহিত্যজগতে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর লেখা সাহসী ও বিদ্রোহী রচনাগুলো তাকে সাহিত্য মহলে এক আলাদা জায়গা প্রদান করেছে।
বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাতি
১৯২২ সালে তার কবিতা “বিদ্রোহী” প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলা সাহিত্যে তাঁর নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়। এই কবিতার মাধ্যমেই তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন । সেই বছরই তার সম্পাদিত “ধূমকেতু” পত্রিকায়, প্রকাশিত রাজনৈতিক প্রবন্ধের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবন্দি করে।
সঙ্গীত ও মানবিকতা
নজরুল ইসলামে সঙ্গীতের জগতে তাঁর প্রতিভা প্রকাশ করেছেন। সেই সাথে, তিনি প্রায় ৪,০০০ গান রচনা ও সুরারোপ করেন, যেগুলি “নজরুল সঙ্গীত” নামে পরিচিত। তিনি তাঁর গান ও কবিতার মাধ্যমে বিদ্রোহ, মানবতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্যের বাণী বার বার করে উচ্চারিত করেছেন।
সাহিত্যজীবনের সমাপ্তি ও অসুস্থতা
১৯৪২ সালে কাজী নজরুল ইসলাম স্নায়বিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হন এবং এর ফলে তার সাহিত্য কর্মে বাধা পড়ে। এর পরবর্তী ৩৪ বছর তিনি নিস্ক্রিয় জীবন কাটান।
উপাধি ও অবদান
কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বিদ্রোহের কবি নন; তিনি বাঙালির মানবিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক চেতনার অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত। তিনি আজীবন ধরে সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছেন এবং মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার বাণী প্রচার করেছেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল:
- কাব্যগ্রন্থ: “অগ্নিবীণা”, “সন্ধ্যামালতি”, “চক্রবাক”
- গান: “দোলন চাঁপা”, “কারার ঐ লৌহ কপাট”
- উপন্যাস: “বাঁধনহারা”, “মৃত্যুখেলা”
তিনি চিরকাল বাঙালির হৃদয়ে বিদ্রোহ, প্রেম ও মানবতার প্রতীক হয়ে বেঁচে আছেন এবং থাকবেন।
বিদ্রোহী নজরুল
১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লা ও দৌলতপুরে ছিলেন। সেখান থেকে তিনি সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেন। তিনি বিদ্রোহের সময় শোভাযাত্রা করতেন ও সভায় অংশ নিয়ে গান গেয়েছেন। এই সময়ে তার লেখা ও সুরারোপিত গানগুলো আন্দোলনের প্রেরণা জুগিয়েছিল।
১৯২২ সালে তার অমর কবিতা বিদ্রোহী প্রকাশিত হয়, যা তাকে সারা ভারতে খ্যাতি এনে দেয়। এই কবিতায় তিনি নিজেকে একটি বিদ্রোহী সত্তা হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন। এই কবিতার বিখ্যাত লাইনগুলো হল:
“আমি চির বিদ্রোহী বীর,
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির।”
সেই সময়ে তাঁর প্রকাশিত পত্রিকা ধূমকেতু, তৎকালীন বিপ্লবী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পত্রিকার একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ‘আনন্দময়ীর আগমন‘ যার জন্য গ্রেফতার করা হয়। তিনি ১৯২৩ সালে রাজবন্দি হিসেবে আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। তিনি আদালতে যে বিখ্যাত জবানবন্দি প্রদান করেন, যা “রাজবন্দীর জবানবন্দি” নামে পরিচিত।
সাহিত্য ও সংগীত
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক নতুন ধারার প্রবর্তক। তাঁর কবিতা ও গান সাম্যবাদ, বিদ্রোহ এবং মানবতার মর্মবাণী প্রচার করে। তার লেখা অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে এক বিপ্লব সৃষ্টি করে। তার বিখ্যাত কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল; বিদ্রোহী, কামাল পাশা এবং প্রলয়োল্লাস ।
কাজী নজরুল ইসলাম প্রায় চার হাজার গান রচনা করেছেন, যা নজরুলগীতি নামে পরিচিত। তার গানে যেমন ইসলামী ভাবধারা পাওয়া যায়, তেমনই শ্যামাসংগীতেও তিনি সমান দক্ষ ছিলেন।
নজরুল তার জীবন ও সাহিত্য দিয়ে ধর্ম, জাতি এবং বর্ণের ঊর্ধ্বে মানবধর্ম প্রচার করেছেন।
অসুস্থতা ও মৃত্যু
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। বাকি জীবন তিনি ঢাকাতেই কাটান। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়