মহাশ্বেতা দেবী: সাহিত্য, জীবনী ও অন্যান্য
মহাশ্বেতা দেবী (১৯২৬–২০১৬) ছিলেন একজন কিংবদন্তি ভারতীয় সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী। তিনি, ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি, ব্রিটিশ ভারতের ঢাকা (বর্তমান বাংলাদেশ)-তে জন্মগ্রহণ করেন। রিনিতার সৃজনশীল লেখনীর মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছেন।
উত্তরাধিকার ও যাত্রা শুরু
মহাশ্বেতা দেবী এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা ছিলেন মনীশ ঘটক, যিনি কল্লোল আন্দোলনের সময়কার এক বিশিষ্ট কবি ও ঔপন্যাসিক ছিলেন। তাঁর মা, ধরিত্রী দেবী, ছিলেন একজন লেখিকা ও সমাজকর্মী। তাঁর পরিবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক এবং ভাস্কর শঙ্খ চৌধুরী।
তিনি ঢাকায় তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু করলেও, তিনি o তাঁর পরিবার পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। এখানে, শান্তিনিকেতন সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন।
এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ জন্মায় যখন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছিলেন।
সাহিত্যকর্ম
মহাশ্বেতা দেবী পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে সাহিত্য রচনা করেছেন। তিনি বাংলা ভাষায় ১০০ টিরও বেশি উপন্যাস এবং ২০ টিরও বেশি ছোটগল্প রচনা করেছেন। তাঁর লেখনীতে আদিবাসী, দলিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনের গল্প প্রতিকৃতি হয়।
তাঁর প্রথম উপন্যাস ছিল ঝাঁসির রানি (১৯৫৬), যেটি ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই-এর জীবনের ওপর এক চমৎকার গবেষণার নির্যাস। তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টির মধ্যে কয়েকটি হল:
- হাজার চুরাশির মা: এটি নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা গল্প। যেটিতে একজন মায়ের দুঃখ ও আত্ম অনুসন্ধানের গল্প বর্ণিত হয়েছে।
- অরণ্যের অধিকার: এই উপন্যাসটি আদিবাসী নেতা বিরসা মুন্ডার জীবনের উপর ভিত্তি করে লেখা। এখানে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে।
- রুদালি: এই উপন্যাসটি পেশাদার শোক প্রকাশকারীদের নিয়ে রচিত এক আবেগঘন গল্প। যেখানে তিনি গ্রামীণ ভারতের জাত ও লিঙ্গ গত বৈষম্যকে তুলে ধরেছেন।
- ছোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর: আদিবাসীর পরিচয় ও প্রতিরোধের এক অনন্য কাহিনীর বর্ণনা দেয় ।
মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্য শুধু শিল্পের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; শোষিতদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন।
শিল্পের মাধ্যমে সমাজকর্ম
মহাশ্বেতা দেবী, তাঁর জীবন আদিবাসী সম্প্রদায়ের উন্নয়নে উৎসর্গ করেছিলেন । পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিসগঢ়ের লোধা ও শবরদের মতো জনগোষ্ঠীর জন্য তিনি অবিরাম কাজ করে গেছেন। তিনি তাঁদের জীবনের সঙ্গে মিশে হয়ে তাঁদের সংগ্রাম থেকে প্রেরণা গ্রহণ করেছিলেন যার বহির্প্রকাশ ঘটে তার সাহিত্যের মধ্য দিয়ে।
লেখালেখি ছাড়াও তিনি, জমি অধিগ্রহণের নামে কৃষকদের উচ্ছেদ এবং গ্রামের মানুষের জীবনে শিল্পায়নের ক্ষতিকর প্রভাবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গে অনেক বুদ্ধিজীবী, শিল্পী এবং লেখকদেরও উদ্বুদ্ধ করে।
বিরশা মুন্ডার মূর্তি থেকে শৃঙ্খল অপসারণে তিনি গুরুত্বপূর্ন ভূমিক গ্রহণ করেছিলে। এই প্রসঙ্গে তাঁর উক্তি:
তিনি বলেছিলেন:
“আমার লেখার কারণ এবং প্রেরণা সেইসব মানুষ, যারা শোষিত এবং ব্যবহৃত হয়, কিন্তু কখনও পরাজয় মেনে নেয় না।”
বিশ্বজুড়ে খ্যাতি
গায়ত্রী চক্রবর্তীর মতো অনুবাদকরা মহাশ্বেতা দেবীর সৃষ্টিকে ইংরেজি ভাষায় রূপান্তর করে আন্তর্জাতিক মহলে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর ইংরেজী গল্পের সংকলন “ইম্যাজিনারি ম্যাপস” এবং “দ্য ব্রেস্ট স্টোরিজ” তাকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি দিয়েছে।
২০০৬ সালে ফ্র্যাংকফুটের এক বইমেলায়, তিনি ভারতের বৈচিত্র্য ও সমস্যাকে তুলে ধরেন এবং সেই বক্তৃতা উপস্থিত শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল।
পুরস্কার ও সম্মাননা
মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্য সৃষ্টি তাকে তাঁকে বহু পুরস্কারে সম্মানিত করেছে, যেমন:
- পদ্মশ্রী (১৯৮৬)
- পদ্মবিভূষণ (২০০৬)
- জ্ঞানপীঠ পুরস্কার (১৯৯৬)
- রেমন ম্যাগসেসে পুরস্কার (১৯৯৭)
- সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৭৯)।
- ২০১২ সালে তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম মনোনীত করা হয়।
চলচ্চিত্রে রূপান্তর
তাঁর বেশ কয়েকটি রচনা চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- রুদালি (১৯৯৩), যা জাতভিত্তিক শোষণ এর উদাহরণ তুলে ধরেছে।
- হাজার চৌরাশি কি মা (১৯৯৮)
- গঙ্গোর (২০১০), চোলি কে পিছে গল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরি।
ব্যক্তিগত জীবন ও চ্যালেঞ্জ
মহাশ্বেতা দেবী, ১৯৪৭ সালে, নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্য পরবর্তীতে একজন বিশিষ্ট লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তবে ১৯৬২ সালে, এই সম্পর্কের ইতি ঘটে। পরে তিনি আসিত গুপ্তর সঙ্গে দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, সেটিরও ১৯৭৬ সালে বিচ্ছেদ ঘটে।
শেষদিন এবং উত্তরাধিকার
২০১৬ সালের ২৮ জুলাই, মহাশ্বেতা দেবী বহুমুখী অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকলতার কারণে জীবনাবসান ঘটে। তাঁর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ দেশজুড়ে বহূ মানুষ শোকবার্তা প্রকাশ করেন।
২০১৮ সালে গুগল ডুডল তাঁর ৯২তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন।
চিরন্তন অনুপ্রেরণা
মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্য ও সক্রিয়তা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল এবং তাঁদের সংগ্রামকে গল্পকে সারা তুলে ধরেছিলেন।
তাঁর কথায়:
“যখন আমি তাঁদের জানতে শুরু করেছি, তখন অন্য কোথাও কেন আমার কাঁচামাল খুঁজতে যাব?“
মহাশ্বেতা দেবী, এক আশার আলো এবং দৃঢ়তার প্রতীক, তাঁর কাজ এবং চিন্তাধারা অসংখ্য জীবনকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে।