প্রেমেন্দ্র মিত্র: আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য কল্পনাকারী
প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় প্রতিভা। তিনি তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞান ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিলেন। ১৯০৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, উত্তর প্রদেশের বারাণসীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন তবে তাঁর জন্ম নেন তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার রাজপুরে।
শৈশব ও পরিবার
প্রেমেন্দ্র মিত্রের পিতার নাম ছিল জ্ঞানেন্দ্রনাথ মিত্র এবং মাতার নাম সুহাসিনী দেবী। খুব অল্প বয়সেই তিনি মাতৃহারা হন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের হওয়া পিতৃকুল ছিল হুগলি জেলার কোন্নগরের এক সম্ভ্রান্ত বংশ।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাহিত্য জীবনের সূচনা
কলকাতার গোবিন্দ ঘোষাল লেনের মেসবাড়িতে থাকার সময় প্রেমেন্দ্র মিত্র তার সাহিত্যিক জীবনের প্রথম গল্প রচনা করেন। ১৯২৩ সালে ঢাকায় পড়াশোনা শেষে কলকাতায় ফিরে একটি পোস্টকার্ড থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখলেন ‘শুধু কেরানি’ এবং ‘গোপনচারিণী’।
১৯২৪ সালে এই দুটি গল্প জনপ্রিয় পত্রিকা প্রবাসী-তে প্রকাশিত হয়। এরপরে কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সংক্রান্তি’, তাকে সাহিত্য জগতে সুপরিচিত করে তোলে।
কবিতার জগতে অবদান
১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথম কবিতার বই “প্রথমা“। ‘আজ এই রাস্তার গান গাইব’ কবিতাটি গদ্য ছন্দে লেখা তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা।
প্রেমেন্দ্র মিত্র: বাংলা গল্প ও উপন্যাসে ভূমিকা
প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প ও উপন্যাসগুলি মানুষের সম্পর্কের জটিলতা, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের বেদনাভরা জীবন, সমাজের ভাঙাগড়া ইত্যাদি তুলে ধরে। তার প্রথমদিকের গল্প সংকলনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য “পঞ্চশর“, “বেনামী বন্দর“, এবং “পুতুল ও প্রতিমা“। এছাড়াও তার উপন্যাসগুলোর মধ্যে “পাঁক” (১৯২৬) এবং “মিছিল” (১৯২৮) পাঠকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
ঘনাদা চরিত্রের সৃষ্টিকর্তা
প্রেমেন্দ্র মিত্রের সৃষ্ট চরিত্র ঘনাদা বাংলা সাহিত্যের এক আবেগ। ১৯৪৫ সালে প্রথম, বনমালী নস্কর লেনের মেস বাড়ির বাসিন্দা এই গল্পবাগীশ চরিত্রের উদয় ঘটে।
বাংলা কল্পবিজ্ঞানে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ভূমিক
প্রেমেন্দ্র মিত্র বাংলা সাহিত্যের প্রথম সাহিত্যিক যিনি নিয়মিত কল্পবিজ্ঞান নিয়ে লিখতেন। ১৯৩০ সালে তার লেখা “পিঁপড়ে পুরাণ ” বাংলার কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের ইতিহাসে এক মাইলফলক। তার অন্যান্য বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান রচনার মধ্যে রয়েছে “পাতালে পাঁচ বছর“, “শুক্রে যারা গিয়েছিল“, এবং “সূর্য যেখানে নীল“।
চলচ্চিত্র জগতে অবদান
চলচ্চিত্রের দুনিয়াতেও প্রেমেন্দ্র মিত্রের অবদান উল্লেখযোগ্য। তার পরিচালিত সিনেমার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল “পথ বেঁধে দিল“, “চুপি চুপি আসে“, এবং “হানাবাড়ি“। তিনি বহু সিনেমার কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার এবং উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেছেন।
পুরস্কার ও সম্মান
প্রেমেন্দ্র মিত্র তার সাহিত্যকর্মের জন্য অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- রবীন্দ্র পুরস্কার
- সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার
- পদ্মশ্রী
- আনন্দ পুরস্কার
- জগত্তারিণী স্বর্ণপদক
- বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট ডিগ্রি
মৃত্যু
১৯৮৮ সালের ৩ মে পাকস্থলীর ক্যান্সারের কারণে প্রেমেন্দ্র মিত্র কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগের বছর পর্যন্তও তিনি সাহিত্য রচনায় মগ্ন ছিলেন।
প্রেমেন্দ্র মিত্র আজও বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে স্মরণীয় এবং বরণীয়। তাঁর রচনা পাঠকদেরকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অনুপ্রেরণা জোগাবে।