রামপ্রসাদ সেন: জীবনী, সাহিত্যকর্ম, ভক্তি ও অন্যান্য

Spread the love

রামপ্রসাদ সেন ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক অমর কবি ও ভক্তি আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তিনি ছিলেন অষ্টাদশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি, যাঁর কাব্যরচনায় আধ্যাত্মিক অনুভূতি ও ভক্তির গভীরতা প্রকাশ পেয়েছে।

  1. রাজশেখর বসু (পরশুরাম) : জীবনী, সাহিত্য এবং অন্যান্য
  2. সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়: শৈশব এবং শিক্ষাজীবন, সাহিত্যিক জীবন ও প্রধান রচনাসমূহ
  3. হুমায়ূন আহমেদ: জীবনবৃত্তান্ত, সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

রামপ্রসাদ সেনের প্রারম্ভিক জীবন

রামপ্রসাদ সেন, যিনি ‘কবিরঞ্জন‘ নামে পরিচিত। তিনি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত কুমারহট্ট গ্রামে (বর্তমানে হালিসহর) এক তান্ত্রিক বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

যদিও তার প্রকৃত জন্ম তারিখ জানা যায় না, তবে সাধারনভাবে মনে করা হয় যে তার জন্ম ১৭১৮ অথবা ১৭২৩ সালে। তার পিতা, রামরাম সেন ছিলেন একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ও সংস্কৃত পণ্ডিত, এবং তার মা, সিদ্ধেশ্বরী দেবী ছিলেন রামরাম সেনের দ্বিতীয়া পত্নী।

ছোটবেলা থেকেই রামপ্রসাদ কবিতা ও বিভিন্ন ভাষায় গভীর আগ্রহ প্রকাশ করতেন এবং এই আগ্রহ তাকে ভবিষ্যতে একজন মহান কবি ও সাধক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

শৈশব ও শিক্ষা

রামপ্রসাদের শৈশব কাটে কুমারহট্ট গ্রামে। বাল্যকালে তিনি সংস্কৃত টোলে শিক্ষালাভ করেন, যেখানে তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ, সাহিত্য, ফার্সি ও হিন্দি ভাষার শিক্ষা গ্রহণ করেন। তার কাব্য রচনার প্রতি অনুরাগ এবং নতুন ভাষা শেখার প্রচেষ্টা শৈশব থেকেই ছিল।

তার পিতা চেয়েছিলেন যে রামপ্রসাদ পারিবারিক আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনা করুক। কিন্তু রামপ্রসাদের মন তাতে ছিল না বরং আধ্যাত্মিক জীবনে তার অধিক আগ্রহ ছিল। তার এই আধ্যাত্মিক আগ্রহ পরবর্তীকালে তাকে একজন শাক্ত কবি ও সাধক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

রামপ্রসাদ সেনের বিবাহ ও আধ্যাত্মিক যাত্রা

বাইশ বছর বয়সে রামপ্রসাদের, সর্বাণী নামে এক বালিকার সাথে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহের পর, পরিবারিক প্রথানুযায়ী, নবদম্পতি কুলগুরু মাধবাচার্যের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন।

কথিত আছে, দীক্ষাগ্রহণকালে গুরু তার কানে মন্ত্র দেওয়ার ফলে তিনি দেবী কালীর অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এক বছর পর তার গুরুর মৃত্যু হলে, রামপ্রসাদ তান্ত্রিক যোগী ও পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

আগমবাগীশ ছিলেন বঙ্গদেশে কালী আরাধনার প্রবর্তক এবং সুপ্রসিদ্ধ শাক্ত তন্ত্রগ্রন্থ তন্ত্রসারের রচয়িতা। তিনি রামপ্রসাদকে তন্ত্রসাধনা ও কালীপূজার পদ্ধতি প্রভৃতির শিক্ষা দেন।

কর্মজীবন ও কবিতা

পিতার মৃত্যুর পর রামপ্রসাদের পরিবারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কঠিন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় রামপ্রসাদকে কর্মে নিযুক্ত হতে হয়।

তিনি কলকাতায় এসে দুর্গাচরণ মিত্র নামে এক ধনীর কাছারিতে মাসিক ত্রিশ টাকা বেতনে কেরানির কাজ শুরু করেন। তবে তার গানের প্রতি গভীর আগ্রহ তাকে গীতিকবিতা রচনা করতে উদ্বুদ্ধ করে।

কথিত আছে যে, কাছারির হিসাবের খাতায় তিনি শ্যামাসঙ্গীত লিখতে শুরু করলে, অন্যান্য কর্মচারীরা তাদের মালিকের নিকট রামপ্রসাদের বিরুদ্ধে নালিশ জানান।

কিন্তু দুর্গাচরণ মিত্র গানগুলি পড়ে রামপ্রসাদের কবি শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি কবিকে কেরানির কাজ থেকে অব্যহতি দিয়ে নিজের গ্রামে পাঠান এবং তার মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করেন।

রামপ্রসাদ সেনের সাধনা ও কাব্যরচনা

গ্রামে ফিরে রামপ্রসাদ কঠোর তন্ত্র সাধনায় মগ্ন হন। জানা যায়, এই সময় তিনি আকণ্ঠ গঙ্গাজলে নিমজ্জিত অবস্থায় শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন।

তান্ত্রিক প্রথা অনুযায়ী, তন্ত্রসাধনার আদর্শ পবিত্র ‘পঞ্চবটী’র (বট, বেল, আমলকি, অশোক ও অশ্বত্থ গাছের সম্মিলিত রূপ) তলায় ‘পঞ্চমুণ্ডী’র (সাপ, ব্যাঙ, খরগোশ, শৃগাল ও মানুষের করোটীর দ্বারা সৃষ্ট আসন) আসনে বসে ধ্যান ও সাধনা করতেন।

লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, দেবী কালী আদ্যাশক্তি মহামায়া রূপে তাকে দর্শন দিয়েছিলেন।

রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা

কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় রামপ্রসাদের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি নিজেও ছিলেন কালীভক্ত। তাই রামপ্রসাদকে তিনি সভাকবির মর্যাদা দেন।

রামপ্রসাদ অবশ্য মহারাজের রাজসভায় বিশেষ আসতেন না। তিনি তন্ত্রসাধনা ও কালীপূজাতেই অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করতেন। কৃষ্ণচন্দ্র তাকে ১০০ একর (০.৪০ বর্গকিলোমিটার, ০.১৬ বর্গমাইল) করমুক্ত জমি প্রদান করেন। এর প্রতিদানে রামপ্রসাদ তার “বিদ্যাসুন্দর” কাব্যটি কৃষ্ণচন্দ্রকে উৎসর্গ করেন।

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে কবিরঞ্জন উপাধিতেভূষিত করেছিলেন। মহারাজের অন্তিম সময়ে রামপ্রসাদ তার পাশে থেকে তাকে কালীর নামগান শুনিয়েছিলেন।

শোনা যায় যে, নবাব সিরাজদ্দৌলা ও সুফি সন্তেরাও রামপ্রসাদের আধ্যাত্মিক সংগীতে মুগ্ধ হন। নবাবের অনুরোধে রামপ্রসাদ একবার তার সভাতেও গিয়েছিলেন বলে কথিত আছে।

রামপ্রসাদ সেনের কবির প্রতিভা ও কাব্যরচনা

শুধু মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রামপ্রসাদ সেনের সৃষ্টি উল্লেখযোগ্য। তিনি দেবী বিষয়ক শাক্ত পদাবলী রচনা করলেও জনমানুষের সুখ-দুঃখের চিত্রও ফুটে উঠেছে।

তার কাব্যগুলিকে কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত করা যায়: উমা বিষয়ক (আগমনী ও বিজয়া), সাধন বিষয়ক (তন্ত্রোক্ত সাধনা), দেবীর স্বরূপ বিষয়ক, তত্ত্ব দর্শন ও নীতি বিষয়ক, এবং কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি বিষয়ক।

রামপ্রসাদের রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্য ছিল তার রচনাগুলো দেবীর স্বরূপ অন্বেষণ করা। তিনি কখনো মাকে অনুরোধ করতেন, আবার কখনো হতাশায় বিরক্ত হয়ে বলতেন:

“এবার কালি তোমায় খাবো, এবার তুমি খাও কি আমি খাই মা, দুটোর একটা করে যাব”

আধুনিকতার প্রভাব

রামপ্রসাদ তার কাব্য রচনায় বাস্তব দুঃখ এবং তা থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন। তার কাব্যে ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের মিশ্রণ বাংলার জনমানুষের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে। তার জনপ্রিয় রচনাগুলি হল বিদ্যাসুন্দর, কালীকীর্তন, কৃষ্ণকীর্তনশক্তিগীতি

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

কথিত আছে যে, তিনি প্রতি অমাবস্যায় কালীপূজা করতেন। একবার সারারাত পূজা ও গানের পর সকালে কালীপ্রতিমা মাথায় করে নিয়ে গঙ্গার দিকে বিসর্জনের পথে বের হন। ভক্তগণ তার পিছন পিছন বিসর্জন শোভাযাত্রায় অংশ নেন। স্বরচিত শ্যামাসঙ্গীত গাইতে গাইতে তিনি গঙ্গার জলে প্রতিমা বিসর্জন দিতে অবগাহন করেন এবং তখনই তার প্রাণত্যাগ হয়।

তাঁর কাব্যরচনা, বিশেষত শ্যামাসঙ্গীত, আজও বাঙালি সংস্কৃতিতে সমান জনপ্রিয়। তার শ্যামাসঙ্গীতগুলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম সহ অন্যান্য কবি ও সংগীতকারদের দ্বারা অনুপ্রাণিত।

Similar Posts

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *